স্টাফ রিপোর্টার : পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ১৯৮৭ সালে একটি সোয়েটার কারখানা স্থাপন করেন মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস। এই কারখানায় উৎপাদনের মাধ্যমে সোয়েটারের বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। তখন শুধুমাত্র এই বাজারে ছিল চীনের আধিপত্য।

সে সময়ে গোলাম কুদ্দুস তার কারখানার জন্য ৪৩ জন চীনা বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসেন। এরপরের ঘটনায় দেশের ব্যবসায়ী মহল অবাক হয়ে যায়। পরীক্ষামূলক শুরুর প্রথম বছরেই গোলাম কুদ্দুস ৩০ লাখ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেন। কুদ্দুসের চেউং হিং সোয়েটারকে এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।

গোলাম কুদ্দুস এখন রপ্তানিমুখী সুয়েটার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ড্রাগন গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি। একই সঙ্গে রূপালী ইনস্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান তিনি। দুটি প্রতিষ্ঠানই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।

সেই ৩০ লাখ ডলারের রপ্তানি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। দিন দিন বাড়ছে রপ্তানির পরিমাণ। আন্তর্জাতিক সোয়েটার বাজারে নিজের অংশীদারিত্ব ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে বাংলাদেশ।

এখন প্রায় ৪০০ সোয়েটার কারখানায় চব্বিশ ঘণ্টাই স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন লাইন চালু থাকে। ম্যানুয়াল হ্যান্ড ফ্ল্যাট নিটিং ডিভাইসের জায়গায় এসেছে আধুনিক এবং স্বয়ংক্রিয় জ্যাকার্ড মেশিন। মৌলিক নিটওয়্যারের মধ্যে আছে পুলওভার, কার্ডিগান, জাম্পার ও মাফলার।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য (বিজিএমইএ) অনুসারে, চীন সোয়েটার তৈরি থেকে সরে যাওয়ায় গত ছয় বছরে বাংলাদেশের সোয়েটার রপ্তানি ২৭ শতাংশ বেড়েছে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, অন্যান্য পণ্যের তুলনায় এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে বেশি।

কোভিড-আতঙ্ক কাটিয়ে অর্থনীতিগুলো ফের চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল পরিমাণে বেড়েছে সোয়েটারের চাহিদা। সে কারণে সোয়েটার প্রস্তুতকারকরা এখন নতুন বিনিয়োগ ও কারখানার সম্প্রসারণের দিকে নজর দিচ্ছে।

বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম জানিয়েছেন, ২০২১ সালে এ খাতে পাঁচটি নতুন বিনিয়োগ হয়েছে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি সোয়েটার তৈরির ইউনিট উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছে।

দুজন উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, আগামী দুই বছরে তারা সোয়েটার তৈরিতে আরও বেশি বিনিয়োগ করবেন। আগামী মাসগুলোতে সোয়েটার উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন শহীদুল্লাহ আজিমও।

সোয়েটার তৈরির জন্য চীনা কর্মী নিয়োগ দিতে হয়েছিল মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসকে। তিনি বলেন, প্রশিক্ষিত স্থানীয় কর্মী গড়ে তুলেই বাজিমাত করেছে বাংলাদেশ।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এখন তার ড্রাগন সোয়েটারের জন্য সুপরিচিত। স্থানীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ১৯৯৩ সালে তিনি এই নিটিং ও স্পিনিং প্রকল্প চালু করেছিলেন।

তিনি বলেন, আমাদের সাফল্য অনেককে সোয়েটার প্রস্তুতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী করেছে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও আপগ্রেডেড মেশিন আনার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক সোয়েটার বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। সবচেয়ে বড় সরবরাহক হচ্ছে চীন। এছাড়া, অন্যান্য বড় প্রতিযোগী হলো- বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, তুরস্ক, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার।

গ্লোবাল নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন আলমগীর রোমেল বলেন, সোয়েটার বেসিক নিটওয়্যার আইটেম হওয়ায় এবং ক্রমে উৎপাদন খরচ বেড়ে চলায় চীন বৈশ্বিক সোয়েটার বাজার থেকে সরে যাচ্ছে। দেশটির এই প্রস্থানে আগামী বছরগুলোয় বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা ব্যাপক সুবিধা পাবে।

তিনটি কারখানার মালিকানা প্রতিষ্ঠান ডিজাইনটেক্স নিটওয়্যার ২০০০ এর দশকে সোয়েটার উৎপাদন শুরু করে। কোম্পানির সত্ত্বাধিকারী খন্দকার রফিকুল ইসলাম ২০২২ সালের শেষ নাগাদ সোয়েটার প্রস্তুতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন।

বর্তমানে তার উৎপাদন ইউনিটগুলোয় ৮ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মরত। তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন কারখানা করার চেয়ে বিদ্যমান কারখানাগুলো তাদের সক্ষমতা বাড়িয়েছে। তার প্রতিষ্ঠানও সোয়েটার প্রস্তুতে বিনিয়োগ বাড়াবে বলে জানান মহিউদ্দিন আলমগীর রোমেল। তবে তিনি এ বিনিয়োগের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানাননি।

উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ মূলত স্বল্প মূল্যের সোয়েটার পণ্যই তৈরি করে। বাংলাদেশ যে ধরণের সোয়েটার রপ্তানি করে, তার বেশিরভাগেরই প্রতিপিছ রপ্তানি মূল্য ৪-৬ মার্কিন ডলার। তবে হাতেগোণা কয়েকটি কারখানা উচ্চমূল্যের পণ্য স্বল্প পরিমাণে রপ্তানি করছে।

তবে “ক্যাশমেয়ার উল সোয়েটার”- এর মতো দামি পণ্য প্রস্তুত করলে স্থানীয় উৎপাদকদের রপ্তানি আয় বাড়বে। এ ধরণের একটি সোয়েটারের দাম ১০০-১৫০ ডলার। তবে এটির কাঁচামাল চীন, মঙ্গোলিয়া ও ভারতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে পণ্যটি উৎপাদিত হয় না বলে জানান উদ্যোক্তারা।

মহিউদ্দিন আলমগীর রোমেল জানান, একজন উদোক্তা কুমিল্লা ইপিজেডে ওই পণ্য তৈরির উদ্যোগ নিলেও সফল হননি। তবে অ্যাক্রেলিক ফাইবার ও কিছু ফ্যাশনেবল অ্যাক্সেসরিজের সমন্বয়ে তৈরি সোয়েটার বাংলাদেশ রপ্তানি করে, যাতে কিছু বাড়তি দর পাওয়া যায়।

দেশের ২০-২৫টি কারখানা বড় পরিসরে সোয়েটার রপ্তানিতে জড়িত।

এই তালিকায় রয়েছে- পাইওনিয়ার নিটওয়্যার (বিডি) লিমিটেড, রিফাত গার্মেন্টস, স্কয়ার ফ্যাশনস, ফ্ল্যামিঙ্গো ফ্যাশন, ইউরোজোন ফ্যাশন, পাকিজা নিট কম্পোজিট লিমিটেড, এজি ড্রেসেস লিমিটেড, জিএমএস কম্পোজিট ইন্ডা. লিমিটেড, নিপা ফ্যাশন ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, একেএইচ নিটিং অ্যান্ড ডাইং, আসওয়াদ কম্পোজিট মিলস, কটন ক্লাব (বিডি), ম্যাট্রিক্স সোয়েটার, টার্গেট সোয়েটার এবং রূপায়ণ সোয়েটার্স।

দেশজ খাতের সোয়েটার রপ্তানির পথচলা তিন দ্শকের বেশি হয়ে গেলেও, দক্ষ জনশক্তির তীব্র সংকট এখনও উদ্যোক্তাদের পিছু ছাড়েনি। কারখানা মালিকেরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মূল কাঁচামাল তুলার দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়াও তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।

এছাড়া, উদ্ভাবন, ডিজাইন সেন্টার স্থাপন এবং শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তৈরিতেও পিছিয়ে রয়েছেন তারা। তার উপর আবার হারমোনাইজড সিস্টেম কোডের জটিলতায় ব্যাহত হচ্ছে কাঁচামাল আমদানি। বিদেশি বড় ব্র্যান্ডের অর্ডার পেতেও সমস্যার মুখে পড়ছেন উদ্যোক্তারা।  তাছাড়া এ খাতে কারখানা স্থাপনের জন্য বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন, যা অপেক্ষাকৃত স্বল্প পুঁজির উদ্যোক্তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

মহিউদ্দিন বলেন, ২০০টি মেশিন নিয়ে একটি ছোট আকারের কারখানা স্থাপন করতে হলেও ১৬ লাখ ডলার কেবল মেশিনেই ব্যয় হবে। ফলে এ খাতে বিনিয়োগ খুব সহজ নয়।এ ধরণের কারখানা ২৪ ঘন্টা চালু রাখতে হয়। এর মধ্যে অন্তত অর্ধেক শ্রমিক পিস রেটে কাজ করে।

এসব শ্রমিকের মাইগ্রেশনের হার বেশি, যা উৎপাদনকে ব্যাহত করে। আগে শ্রমিক চলে গেলেও পাওয়া যেত, কিন্তু এখন সংকট মারাত্নক”- যোগ করেন তিনি।