স্টাফ রিপোর্টার : রতনপুর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান মেসার্স রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের (আরএসআরএম) কাছ থেকে ২০১ কোটি টাকা খেলাপি আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির স্থাবর সম্পত্তি নিলামে তুলতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়েছে সোনালী ব্যাংক।

গত ৫ জানুয়ারি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করা নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে- মেসার্স রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলসের কাছে সোনালী ব্যাংকের ২০১ কোটি ৪৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৬৫ টাকা পাওনা খেলাপি হয়েছে। এই পাওনার বিপরীতে চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকায় গ্রুপটির কারখানাসহ ১০০ শতক জমি বন্ধক রয়েছে। দীর্ঘদিনেও ঋণ পরিশোধ না করায় অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ (সংশোধন ২০১০) এর ১২ ধারার বিধান মোতাবেক প্রতিষ্ঠানটির স্থাপনাসহ এসব স্থাবর সম্পত্তি নিলামে তোলা হবে।

এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের ডিজিএম ও লালদীঘি করপোরেট শাখার প্রধান মো. ইয়াকুব মজুমদার বলেন, ঋণের টাকা শোধ না করায় রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের স্থাপনাসহ ১০০ শতক জমি নিলামে তোলা হবে। শিগগির এই নিলাম অনুষ্ঠিত হবে।

এদিকে, ঋণ পরিশোধে তিনটি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে দুটি রাইট শেয়ার ইস্যু করার আবেদন করলে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে রাইট শেয়ার ইস্যুর আবেদন বাতিল করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কোম্পানিটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে ব্যর্থ হওয়ায় রাইটস শেয়ার ইস্যুর আবেদন বাতিল করেছে বিএসইসি। এরপর থেকে কোম্পানির  অর্থ সংকট আরো ঘনীভূত হতে থাকে।

এ ছাড়া চট্টগ্রামে এই ঋণ আদায়ে গ্রুপটির বিরুদ্ধে অর্থঋণ ও এনআই অ্যাক্টে মোট ১২টি মামলা করেছে ব্যাংকটি।

এক বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক আরএসআরএম গ্রুপের দুটি ইস্পাত কারখানার। দীর্ঘদিনের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকা ও ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের অভাবে ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর গ্রুপটির দুটি কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে গত ৩০ সেপ্টম্বর স্টক এক্সচেঞ্জে চিঠি দিয়ে আরএসআরএমের দুটি কারখানা উৎপাদনে যাওয়ার কথা বলে। ওই ঘোষণার পর আরএসআরএমের শেয়ারের দাম সর্বোচ্চ ৩৮ টাকায় পৌঁছে। এই সুযোগে আরএসআরএমের কর্ণধার তাদের কাছে থাকা ২০ লাখ শেয়ার বিক্রি করে দেয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ২৩ টাকায় নেমে এসেছে।

চট্টগ্রামে বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ইনভেস্টরস ফোরাম চট্টগ্রামের আহ্বায়ক এম এ কাদের বলেন, আরএসআরএম ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। স্টক এক্সচেঞ্জে চিঠি দিয়ে উৎপাদনে যাওয়ার কথা বলেও প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনে যায়নি। এই সুযোগে শেয়ারের দাম বাড়লে কোম্পানিটি তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দেয়। এই শেয়ার কিনে লোকসান দিয়ে বিপাকে রয়েছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

চট্টগ্রামের ইস্পাত খাতের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান রতনপুর গ্রুপ। যেটি আরএসআরএম নামে বেশি পরিচিত। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়া গ্রুপটির বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। যেই কারখানা ঘিরে প্রায় ৮০০ কর্মী উৎপাদন কাজে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু ৪০ কোটি টাকা বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের কারণে গ্রুপটির দুটি কারখানার উৎপাদন গত এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।

গ্রুপটির কাছে বর্তমানে ১০টি ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২২০০ কোটি টাকার ঋণ আটকে আছে। এই পাওনা আদায়ে গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের দুটি এনআই অ্যাক্ট মামলায় গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

রতনপুর গ্রুপের কাছে সবচেয়ে বেশি ১২০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে জনতা ব্যাংক লালদিঘী শাখার। এর মধ্যে মেসার্স মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেডের কাছে ৪০৯ কোটি, মেসার্স রতনপুর শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে ৩১৩ কোটি ও এসএম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের কাছে ৪৮২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।

জনতা ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ও লালদীঘি করপোরেট শাখার প্রধান গোলাম মোস্তফা বলেন, রতনপুর গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে ঋণের টাকা শোধ করছে না। এই পাওনার বিপরীতে তিন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থঋণ ও এনআই অ্যাক্টে ছয়টি মামলা করেছে ব্যাংক। এর মধ্যে এনআই অ্যাক্টে দায়ের করা দুই মামলায় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

রতনপুর গ্রুপের কাছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থাৎ ৬৬৩ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। এর মধ্যে মেসার্স মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেডের কাছে ৪৬২ কোটি ও রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের কাছে ২০১ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে ব্যাংকটির লালদীঘি শাখার।

এ ছাড়াও রতনপুর শিপ রিসাইক্লিংয়ের কাছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ১৫০ কোটি ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৫৬ কোটি, মেসার্স মডার্ন স্টিল রি-রোলিংয়ের কাছে ট্রাস্ট ব্যাংকের ৬০ কোটি, এসএম স্টিল রি-রোলিংয়ের কাছে লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্সের ৫৫ কোটি এবং প্রাইম ফাইন্যান্সের ২৪ কোটি টাকা পাওনা আটকে আছে।

ব্যাংকগুলোর দায়ের করা মামলায় রতনপুর গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাকসুদুর রহমান, চেয়ারম্যান শামসুন নাহার রহমান, এমডির সহোদর ইউনুস ভূঁইয়া, দুই ছেলে মিজানুর রহমান ও মারজানুর রহমান, মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আলা উদ্দিনকে বিবাদী করা হয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে রতনপুর গ্রুপের পরিচালক মারজানুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।